
বাবা বলেছিলেন, “পুলিশ কনস্টেবলের পরীক্ষা দে; না হয় অন্ততঃ গ্রুপ ডি পিওন পোস্টের জন্য চেষ্টা কর। এইসব খেলার ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।”
প্রতিবেশীরা তাদের ছেলেদের বলতো, “আকাশের সাথে মেশার দরকার নেই। নিজে রাতদিন খেলে বেড়ায়, তোদেরও লেখাপড়া ডকে উঠবে।”
-
Akash Deep Singh Biography
ছয় ভাই বোনের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে ছোট। বাবা বিহারের সাসারামের এক সরকারী স্কুলের শিক্ষক; গ্রামের বাকী অভিভাবকদের মত তিনিও সন্তানদের সরকারী চাকরি করার উপদেশ দেন। আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত ভারতীয়র মত আকাশও জীবনের লক্ষ্য বলতে এই ছোট ছোট স্বপ্নপূরণের কথাই জানতেন।
সবটা বদলে গেল যখন ছয় মাসের মধ্যে বাবা আর বড়দা দুজনেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করলেন। যে শক্ত কাঁধ জো রুটের স্টাম্প ছিটকে দেয়, মা ও বোন সহ পুরো পরিবারের দায়িত্ব সেই পনেরো বছরের নাবালক কিশোরের স্কন্ধে নিবেদিত হল। পরিবার সামলাতে বাড়ীর সুখ ছাড়লেন, চলে এলেন এরাজ্যের দুর্গাপুরে।
রোজগারের জন্য ভরসা করলেন তার নিজস্ব প্রতিভার উপর, ক্রিকেটের উপর। লাল বলের পাশাপাশি তিন বছর ক্যাম্বিসে খেপ খেলে বেড়ালেন, মাসে যে তিন চারটে বড় ম্যাচ খেলতেন সেখান থেকে কুড়ি পঁচিশ হাজার টাকা আয় হত। ক্রমশঃ সুযোগ পেলেন CAB এর দ্বিতীয় ডিভিশনে, ইউনাইটেড ক্লাবের হয়ে নিয়মিত খেলা শুরু করলেন।
বাংলার সিনিয়র দলের ডিরেক্টর জয়দীপ মুখার্জী একদিন খেলা দেখতে যান। তিনি লক্ষ্য করেন উল্টো দিক থেকে যখন ফাস্ট বোলিং হচ্ছে, উইকেটকিপার বড়জোর দশ গজ দূরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু এই তরুণ বল করতে এলে কিপার চলে যাচ্ছে পঁয়ত্রিশ গজ পিছনে। ফোন গেল বাংলার প্রাক্তন অফস্পিনার সৌরাশিষ লাহিড়ীর কাছে। ইতিমধ্যেই তৎকালীন CAB প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলী ভিশন 2020 শুরু করেছেন। তাকে লুপে রেখে আকাশকে এই সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যের আওতায় আনা হল, কোন স্থায়ী থাকার জায়গা না থাকায় ইডেনের ডরমিটরি তার নতুন আস্তানা হল।
বাংলার অনূর্ধ্ব 23 দলের কোচ সৌরাশিষ সিলেক্টরদের সাথে রীতিমত ঝামেলা করে তাকে দলে নিলেন। ধীরে ধীরে বাংলার সিনিয়র দলে সুযোগ পেলেন। অনেকেই যেমন এজবাস্টন টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে হ্যারি ব্রুককে করা বলটিকে সেরা বলছেন, তেমনই মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধে রঞ্জি সেমিফাইনালে এক বিষাক্ত ইনসুইঙ্গারে রজত পাতিদারকে আউট করা ডেলিভারিটি এখনও ময়দানে নিয়মিত আলোচিত হয়।
Akash Deep Bioraphy
2024 এর ফেব্রুয়ারীর কথা। কেরালার সাথে রঞ্জি ম্যাচে একটা স্পেল শেষ করে বাউন্ডারিতে ফিল্ডিং করতে এসেছেন। হঠাৎ দেখলেন বাংলার সব প্লেয়াররা ড্রেসিংরুমে দাঁড়িয়ে তার উদ্দ্যেশ্যে হাততালি দিচ্ছেন। খবর এসেছে আকাশ ভারতীয় দলে “দীপ” জ্বেলেছেন, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শেষ তিনটি টেস্ট ম্যাচের স্কোয়াডে তিনি সুযোগ পেয়েছেন।
এরপর ভারতের হয়ে অনিয়মিতভাবে সুযোগ পাওয়া; মধ্যিখানে RCB ছেড়ে LSG এর হয়ে আইপিএল খেলেছেন। মাস দুয়েক আগে আইপিএল চলাকালীন খবর পেলেন তার বড় আদরের দিদি কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত। লক্ষ্ণৌতে থাকলে রোজ প্র্যাকটিস শেষ করে হাসপাতালে দিদিকে দেখতে যেতেন, অপারেশনের দিন দাঁড়িয়ে থেকে সব দিক পরিচালনা করেছিলেন।
এই খবর সকলের অজ্ঞাত ছিল, হয়তো চাইতেন না পারফর্ম করার আগেই এমন ইমোশনাল খবর বেরিয়ে আসুক। টেস্ট ম্যাচে 10 উইকেট নেওয়ার পর যখন ভিক্টরি স্টাম্প এবং বল নিয়ে বেরিয়ে আসছেন, ধারাভাষ্যকার চেতেশ্বর পূজারা জিজ্ঞেস করলেন, “বাড়ীতে এই স্মারকগুলো দেখলে সবাই খুব আনন্দিত হবে বল..!” ক্ষণিকের নিস্তব্ধতা। জোর করে গলা ভিজিয়ে ঈষৎ টেনে টেনে বললেন, “ভাইয়া, আমি এতদিন কাউকে বলিনি, আজ বলছি, আমার দিদি ক্যান্সারে আক্রান্ত। আমি তার কথা ভেবে বল করছিলাম, এই সাফল্য তাকেই উৎসর্গ করলাম।” এখনও ছয় মাসের নিয়মিত চিকিৎসা বাকী; আকাশদীপ রোজ সকালে দিদিকে ফোন করেন আর প্রার্থনা করেন এ যাত্রায় তার দিদির জীবনদীপ প্রজ্জ্বলিত থাকুক।
Sky is NOT the limit, এই আকাশ সীমাহীন, অনন্ত। তাই তো অনায়াসে বলতে পারেন ‘বাবা আর কী করবেন, তিনি লেখাপড়ায় জোর দিয়ে সঠিক কাজই করতেন’, কিংবা ‘প্রতিবেশীরা তাদের সন্তানদের আগলে রেখে প্রকৃত অবিভাবকের কাজ করেছেন, তাদের দোষ দেওয়া যায় না।’ প্রফেশনাল সাফল্য আর ব্যর্থতা তো আসতে যেতে থাকবে, কিন্তু মানুষ হিসেবে উত্থানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এই পরিণত যুবকের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আকাশগঙ্গায় দীপ জ্বেলে যাই, প্রার্থনা করি তোমার মত সুসন্তান ভারতের প্রতিটি ঘরে জন্ম নিক।
এই আর্টিকেলটি তরুণ ঘোষ ফেসবুক প্রোফাইল থেকে উঠানো হয়েছে
Also Read